একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, যোগাযোগ – প্রতিটি ক্ষেত্রেই ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু এই প্রযুক্তির সুফল কি সমাজের সকলের কাছে সমানভাবে পৌঁছাচ্ছে? উত্তরটি, দুর্ভাগ্যবশত, না। প্রযুক্তির এই অসম বণ্টনের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে ‘ডিজিটাল বিভাজন’ – যা উন্নত ও উন্নয়নশীল সকল দেশের জন্যই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই বিভাজন শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত বৈষম্যই নয়, এটি সুযোগের বৈষম্য, তথ্যের বৈষম্য এবং পরিণামে জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য তৈরি করে। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে এই ডিজিটাল বিভাজন হ্রাস করা তাই আজ সময়ের দাবি। এই অন্বেষণে আমরা ডিজিটাল বিভাজনের বিভিন্ন দিক, এর কারণ, প্রভাব এবং তা কমিয়ে আনার সম্ভাব্য উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ডিজিটাল বিভাজন: সংজ্ঞা, কারণ ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
ডিজিটাল বিভাজন একটি বহুমাত্রিক ধারণা যা কেবল ইন্টারনেট বা কম্পিউটারের সহজলভ্যতার অভাবকে বোঝায় না, বরং এর সাথে জড়িত আরও অনেক সূক্ষ্ম বিষয় রয়েছে। এই অংশে আমরা এর সংজ্ঞা, মূল কারণসমূহ এবং বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করব।
ডিজিটাল বিভাজনের প্রকৃত অর্থ ও এর বিভিন্ন স্তর
ডিজিটাল বিভাজন বলতে সাধারণভাবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে (আইসিটি) প্রবেশাধিকার, ব্যবহার এবং এর থেকে সুবিধা লাভের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যকে বোঝায়। এটিকে তিনটি প্রধান স্তরে ভাগ করা যায়। প্রথম স্তরটি হলো ‘অ্যাক্সেস ডিভাইড’ বা প্রবেশাধিকারের বিভাজন, যা মূলত ইন্টারনেট সংযোগ এবং প্রয়োজনীয় ডিভাইস (যেমন কম্পিউটার, স্মার্টফোন) না থাকাকে নির্দেশ করে। দ্বিতীয় স্তরটি হলো ‘ইউসেজ ডিভাইড’ বা ব্যবহারের বিভাজন; অর্থাৎ, ডিভাইস ও ইন্টারনেট থাকলেও সেটিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করার মতো দক্ষতা বা জ্ঞানের অভাব। অনেকেই হয়তো স্মার্টফোন ব্যবহার করেন কেবল কথা বলার জন্য, কিন্তু এর অন্যান্য অসংখ্য অ্যাপ্লিকেশন বা শিক্ষামূলক ব্যবহার সম্পর্কে অবগত নন। তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তরটি হলো ‘আউটকাম ডিভাইড’ বা ফলাফলের বিভাজন। এর অর্থ হলো, প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের জীবনযাত্রার মান, অর্থনৈতিক সুযোগ বা সামাজিক অংশগ্রহণে কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারছে, সেই পার্থক্য। উদাহরণস্বরূপ, দুজন ব্যক্তির ইন্টারনেট থাকলেও একজন তা ব্যবহার করে নতুন দক্ষতা অর্জন করে ভালো চাকরি পাচ্ছেন, আর অন্যজন পারছেন না – এটি ফলাফলের বিভাজন। এই তিনটি স্তর একে অপরের সাথে সংযুক্ত এবং একটি সামগ্রিক ডিজিটাল বৈষম্য তৈরি করে।
বিভাজনের নেপথ্যে থাকা আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক কারণসমূহ
ডিজিটাল বিভাজনের পেছনে अनेक আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা একটি প্রধান কারণ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে কম্পিউটার, স্মার্টফোন কেনা বা নিয়মিত ইন্টারনেট ডেটার খরচ বহন করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, ভৌগোলিক অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলে এখনও ইন্টারনেট অবকাঠামো সেভাবে গড়ে ওঠেনি, ফলে সেসব এলাকার মানুষ ডিজিটাল সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এই বিভাজন প্রকট। তৃতীয়ত, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ডিজিটাল স্বাক্ষরতার অভাব। প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য ন্যূনতম শিক্ষা ও কারিগরি জ্ঞান প্রয়োজন। নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষের পক্ষে আধুনিক প্রযুক্তি আত্মস্থ করা এবং তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা চ্যালেঞ্জিং। চতুর্থত, লিঙ্গবৈষম্য ডিজিটাল বিভাজনের অন্যতম কারণ। অনেক সমাজে, বিশেষত গ্রামীণ ও রক্ষণশীল পরিবেশে, নারীদের প্রযুক্তি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হয় বা তাদের সুযোগ কম থাকে। এছাড়া বয়সও একটি ফ্যাক্টর; প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের হার তুলনামূলকভাবে কম। এই কারণগুলো সম্মিলিতভাবে ডিজিটাল বিভাজনকে আরও গভীর করে তোলে এবং একটি অসম সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশে ডিজিটাল বিভাজনের বর্তমান চিত্র ও পরিসংখ্যান
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে দেশ অনেকখানি এগিয়ে গেলেও ডিজিটাল বিভাজন এখনও একটি বড় বাস্তবতা। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও গুণগত ব্যবহার এবং ডিভাইস মালিকানার ক্ষেত্রে বৈষম্য বিদ্যমান। শহর ও গ্রামের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের পার্থক্য উল্লেখযোগ্য। শহরে যেখানে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সহজলভ্য, সেখানে অনেক গ্রামে এখনও নির্ভরযোগ্য মোবাইল ইন্টারনেটও পৌঁছায়নি। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও ফিচার ফোনের ব্যবহারকারীও কম নয়, যা ডিজিটাল সেবার পূর্ণাঙ্গ সুবিধা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনও স্পষ্ট; পুরুষদের তুলনায় নারীদের ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন ব্যবহারের হার কম। শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং আয়ের স্তরের সাথেও ডিজিটাল সুবিধা প্রাপ্তির সরাসরি সম্পর্ক দেখা যায়। কোভিড-১৯ মহামারীকালে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও ডিভাইস ও ইন্টারনেটের অভাবে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এর বাইরে থেকে গেছে, যা এই বিভাজনকে আরও প্রকটভাবে সামনে এনেছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ সত্ত্বেও, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, ডিজিটাল স্বাক্ষরতার অভাব এবং সচেতনতার অভাব এই বিভাজনকে টিকিয়ে রেখেছে। এই চিত্র পরিবর্তন করতে সমন্বিত ও লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ জরুরি।
ডিজিটাল বিভাজনের বহুমাত্রিক প্রভাব
ডিজিটাল বিভাজন শুধুমাত্র প্রযুক্তির অসম বণ্টন নয়, এটি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিক্ষা, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক জীবন পর্যন্ত এর প্রভাব বিস্তৃত।
শিক্ষা ক্ষেত্রে সুযোগের অসমতা বৃদ্ধি
ডিজিটাল বিভাজন শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। বর্তমান যুগে অনলাইন শিক্ষা, ডিজিটাল কনটেন্ট, এবং দূরশিক্ষণ পদ্ধতি ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কিন্তু যাদের ইন্টারনেট ও ডিভাইসের অভাব রয়েছে, তারা এই আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়। এটি বিশেষত দরিদ্র এবং গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কোভিড-১৯ মহামারীকালে যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল, তখন অনলাইন ক্লাসই ছিল ভরসা। কিন্তু অসংখ্য শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় ডিভাইস, যেমন স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ, এবং স্থিতিশীল ইন্টারনেট সংযোগের অভাবে ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি। এর ফলে তাদের একটি বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা পূরণ করা কঠিন। এছাড়া, ডিজিটাল রিসোর্স, যেমন ই-বুক, অনলাইন লাইব্রেরি, এবং বিভিন্ন শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট থেকে জ্ঞান আহরণের সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত হয়। এই অসমতা শুধুমাত্র একাডেমিক ফলাফলকেই প্রভাবিত করে না, বরং ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনেও বাধা সৃষ্টি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তাই শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে ডিজিটাল বিভাজন কমানো অপরিহার্য।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা ও আয়-বৈষম্য
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ডিজিটাল বিভাজনের প্রভাব অত্যন্ত প্রকট। আধুনিক অর্থনীতি ক্রমশ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছে। ই-কমার্স, অনলাইন ব্যাংকিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, ফ্রিল্যান্সিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের জন্য ডিজিটাল দক্ষতা ও ইন্টারনেট সংযোগ অপরিহার্য। যাদের এই সুবিধা নেই, তারা এই ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা, বিশেষত যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যবসা করেন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে না পারার কারণে তাদের পণ্যের বাজারজাতকরণ এবং বিক্রয়ের সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। অন্যদিকে, যারা প্রযুক্তিতে দক্ষ, তারা অনলাইন মার্কেটপ্লেসে নিজেদের পণ্য বা সেবা পৌঁছে দিয়ে আয় বাড়াতে পারে। এর ফলে সমাজে আয়-বৈষম্য আরও তীব্র হয়। চাকরির বাজারেও ডিজিটাল দক্ষতা একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। যাদের এই দক্ষতা নেই, তারা ভালো চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি কৃষি ক্ষেত্রেও আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন আবহাওয়ার পূর্বাভাস, ফসলের রোগবালাই সম্পর্কিত তথ্য, এবং বাজারদর জানার জন্য ইন্টারনেট গুরুত্বপূর্ণ। এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এককথায়, ডিজিটাল বিভাজন অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির পথে একটি বড় বাধা।
সামাজিক ও নাগরিক পরিষেবা প্রাপ্তিতে বাধা
ডিজিটাল বিভাজন সামাজিক ও নাগরিক জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সরকার বর্তমানে অনেক নাগরিক সেবা, যেমন জন্ম-নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, বিভিন্ন সরকারি ফর্ম পূরণ, বিল পরিশোধ ইত্যাদি অনলাইনে প্রদান করছে (ই-গভর্ন্যান্স)। যাদের ইন্টারনেট অ্যাক্সেস বা ব্যবহারের দক্ষতা নেই, তারা এই সেবাগুলো সহজে গ্রহণ করতে পারে না, ফলে তাদের হয়রানির শিকার হতে হয় বা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও টেলিমেডিসিন বা অনলাইন স্বাস্থ্য পরামর্শ ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে, কিন্তু ডিজিটালভাবে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এছাড়া, বিভিন্ন সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম, দুর্যোগকালীন জরুরি सूचना, এবং সরকারের নীতি সম্পর্কিত তথ্য প্রায়শই ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচার করা হয়। যারা এই মাধ্যমের বাইরে, তারা সময়মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় না, যা তাদের নিরাপত্তা ও অধিকারকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো একে অপরের সাথে যুক্ত থাকা, মত প্রকাশ করা এবং বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়। ডিজিটাল বিভাজনের কারণে একটি উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী এই সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকেও দূরে থাকে, যা তাদের বিচ্ছিন্নতা বাড়ায় এবং সামাজিক সংহতি ব্যাহত করে।
ডিজিটাল বিভাজন হ্রাসে সমন্বিত উদ্যোগ ও করণীয়
ডিজিটাল বিভাজন হ্রাস করা একটি জটিল প্রক্রিয়া যার জন্য সরকার, বেসরকারি খাত, এবং সুশীল সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কার্যকর নীতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব।
সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট ও ডিভাইস সহজলভ্যকরণ
ডিজিটাল বিভাজন কমানোর প্রথম এবং প্রধান ধাপ হলো সকলের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সেবা এবং প্রয়োজনীয় ডিভাইস (যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব) সহজলভ্য করা। এই লক্ষ্যে সরকারকে টেলিযোগাযোগ সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয় করে ইন্টারনেটের ডেটা প্যাকেজের মূল্য কমাতে উৎসাহিত করতে হবে, বিশেষত শিক্ষার্থী এবং নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ সম্প্রসারণের জন্য সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক ইউনিয়ন পর্যায় থেকে গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চলমান প্রকল্পগুলো দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। পাশাপাশি, মোবাইল নেটওয়ার্কের মান উন্নয়ন এবং ফোর-জি কভারেজ সর্বত্র নিশ্চিত করা জরুরি। ডিভাইস সহজলভ্য করার জন্য সরকার আমদানিকৃত ডিভাইসের উপর শুল্ক হ্রাস করতে পারে অথবা দেশে ডিভাইস উৎপাদনের জন্য প্রণোদনা দিতে পারে। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে ডিভাইস বিতরণের কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়াও, কমিউনিটি ইন্টারনেট সেন্টার বা তথ্য কেন্দ্র স্থাপন করে সেখানে বিনামূল্যে বা স্বল্প খরচে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে, যা অনেকের জন্য প্রাথমিক প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করবে।
ডিজিটাল স্বাক্ষরতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মসূচি জোরদারকরণ
শুধুমাত্র ইন্টারনেট সংযোগ ও ডিভাইস থাকাই যথেষ্ট নয়, সেগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন ডিজিটাল স্বাক্ষরতা ও সচেতনতা। এই লক্ষ্যে দেশব্যাপী ব্যাপকভিত্তিক ডিজিটাল স্বাক্ষরতা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে ডিজিটাল লিটারেসি ও সাইবার সুরক্ষার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে যাতে তারা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে গাইড করতে পারেন। বয়স্ক জনগোষ্ঠী, নারী এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করতে হবে, যেখানে তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় ডিজিটাল দক্ষতা, যেমন অনলাইন বিল পরিশোধ, সরকারি সেবা গ্রহণ, তথ্য অনুসন্ধান, এবং নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার শেখানো হবে। গণমাধ্যম, যেমন টেলিভিশন, রেডিও, এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে ডিজিটাল প্রযুক্তির সুফল এবং এর নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এবং এনজিওগুলো এই সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মানুষের মধ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রতি ভীতি দূর করে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে পারলে এর ব্যবহার বাড়বে এবং বিভাজন কমবে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে অবকাঠামো ও কনটেন্ট উন্নয়ন
ডিজিটাল বিভাজন কমাতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। একটি শক্তিশালী সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) মডেলের মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং স্থানীয় ভাষায় ব্যবহারোপযোগী ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরিতে গতি আনা সম্ভব। বেসরকারি টেলিযোগাযোগ সংস্থাগুলো তাদের কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অংশ হিসেবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য বিশেষ ইন্টারনেট প্যাকেজ চালু করতে পারে। সফটওয়্যার ও আইটি কোম্পানিগুলো স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী অ্যাপ্লিকেশন ও কনটেন্ট তৈরি করতে পারে, যা সাধারণ মানুষের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারকে আরও সহজ ও আকর্ষণীয় করে তুলবে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য বাংলায় ব্যবহারোপযোগী মোবাইল অ্যাপস তৈরি করা যেতে পারে। সরকার এই ধরনের উদ্যোগকে নীতি সহায়তা এবং প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করতে পারে। এছাড়াও, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ডিজিটাল বিভাজনের কারণ ও প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে কার্যকর সমাধানের পথ দেখাতে পারে। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে এবং ডিজিটাল বৈষম্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
উপসংহার
ডিজিটাল বিভাজন কেবল একটি প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। এই বিভাজন কমিয়ে আনতে না পারলে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে না এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন অসম্ভব হয়ে পড়বে। সাশ্রয়ী মূল্যে প্রযুক্তির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা, ডিজিটাল স্বাক্ষরতা বৃদ্ধি, এবং স্থানীয় ভাষায় প্রয়োজনীয় কনটেন্ট তৈরি করার মাধ্যমে এই বৈষম্য ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং প্রতিটি নাগরিকের সচেতন প্রয়াস। সকলে মিলে কাজ করলে আমরা ডিজিটাল বিভাজনের এই প্রাচীর ভেঙে একটি জ্ঞানভিত্তিক, তথ্যসমৃদ্ধ এবং প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব, যেখানে প্রযুক্তির সুফল সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে এবং সমৃদ্ধ আগামীর পথ প্রশস্ত হবে।