বর্তমান বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানির ভাণ্ডার সীমিত হয়ে আসছে এবং পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা শুধুমাত্র একটি বিকল্প নয়, বরং সময়ের অপরিহার্য দাবি। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়োমাস ইত্যাদি প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত অফুরন্ত শক্তির উৎসগুলিই হলো নবায়নযোগ্য শক্তি, যা আমাদের একটি সুস্থ ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে চালিত করতে পারে।
কেন নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুঁকতে হবে?
জীবাশ্ম জ্বালানির (কয়লা, তেল, গ্যাস) ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা আমাদের পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের মুখে। এর দহনে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি করছে, যার ফলস্বরূপ জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের প্রধান সুবিধা হলো এটি পরিবেশবান্ধব। এটি কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া, এটি আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, কারণ এর জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় না। দীর্ঘমেয়াদে এটি অর্থনৈতিকভাবেও সাশ্রয়ী এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক।
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দেশে বছরের অধিকাংশ সময়ই পর্যাপ্ত সূর্যালোক থাকে। এছাড়া, উপকূলীয় অঞ্চলে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনেরও সুযোগ রয়েছে। কিছু কিছু জলবিদ্যুৎ প্রকল্পও কার্যকর। তবে, নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে কিছু প্রতিবন্ধকতাও বিদ্যমান। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রাথমিক বিনিয়োগের উচ্চ ব্যয়, উন্নত প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, জমির স্বল্পতা (বিশেষত বৃহৎ সোলার প্যানেল স্থাপনের জন্য) এবং বর্তমান গ্রিড ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করা জরুরি।
সরকারি উদ্যোগ ও নীতি সহায়তা
নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হলে সরকারি স্তরে দৃঢ় পদক্ষেপ ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অপরিহার্য। সরকারকে আর্থিক প্রণোদনা, ভর্তুকি এবং সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তি সংক্রান্ত গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি, বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করতে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে নীতি সহায়তা প্রদান করতে হবে। ‘সোলার হোম সিস্টেম’ কর্মসূচির মতো সফল উদ্যোগগুলোকে আরও বিস্তৃত করতে হবে। জনগণকে সচেতন করা এবং তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
নাগরিক সচেতনতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ
শুধুমাত্র সরকারি প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়, নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে প্রতিটি নাগরিকের সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। বাসাবাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন, বিদ্যুতের অপচয় রোধ, এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে উৎসাহী হওয়া ব্যক্তিগত স্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম এই বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ে ছোট ছোট সামাজিক উদ্যোগ, যেমন কমিউনিটি সোলার প্রকল্প, এক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। পরিবেশবান্ধব জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া আমাদের সম্মিলিত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
উপসংহার
পরিশেষে, এটা স্পষ্ট যে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এটি শুধুমাত্র পরিবেশ সুরক্ষাই করবে না, বরং আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত করবে। সরকার, বেসরকারি খাত এবং সাধারণ মানুষ—সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই লক্ষ্য অর্জন করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ ও সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে। নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে যাত্রা কেবল একটি পরিবর্তন নয়, এটি একটি বিপ্লব, যা আমাদের সকলের অংশগ্রহণে সফল হবে।