উদ্যোক্তা শব্দটি আমাদের মানসপটে এমন এক ব্যক্তির ছবি আঁকে যিনি স্বপ্ন দেখেন, সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য অসীম সাহস সঞ্চয় করেন এবং প্রচলিত পথের বাইরে গিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করার ঝুঁকি নিতে পিছপা হন না। তিনি কেবল একজন ব্যবসায়ী নন, বরং একজন উদ্ভাবক, একজন নেতা এবং সমাজের সমস্যা সমাধানে নিবেদিত প্রাণ। একজন উদ্যোক্তার পথচলা শুরু হয় একটি ধারণা বা স্বপ্নকে কেন্দ্র করে, যাকে তিনি কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে একটি সফল উদ্যোগে পরিণত করেন এবং এর দ্বারা নিজের ও সমাজের জন্য নতুন মূল্য সৃষ্টি করেন।
উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করে নতুন কিছু গড়ার অদম্য ইচ্ছা এবং নিজের কাজের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার আকাঙ্ক্ষা। তাঁদের চরিত্রে মিশে থাকে অপার কৌতূহল, যেকোনো প্রতিকূলতাকে সাহসের সাথে মোকাবিলা করার মানসিকতা এবং ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে দ্বিগুণ উদ্যমে পুনরায় কাজ শুরু করার দৃঢ়তা। একজন বিচক্ষণ উদ্যোক্তা বাজারের প্রকৃত চাহিদা অনুভব করতে পারেন, সেই অনুযায়ী মানসম্পন্ন পণ্য বা সেবা প্রস্তুত করেন এবং গ্রাহকের কাছে তা দক্ষতার সাথে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ফলপ্রসূ বিপণন কৌশল অবলম্বন করেন।
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উদ্যোক্তাদের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরা নতুন নতুন শিল্প ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্র তৈরি করেন, যার ফলশ্রুতিতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি মেলে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। উদ্যোক্তারা প্রায়শই গতানুগতিক চিন্তাধারাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নিত্যনতুন প্রযুক্তি ও কর্মপদ্ধতির প্রবর্তন ঘটান, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামগ্রিক উন্নয়নের চাকাকে সচল রাখে। স্থানীয় সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করে এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে তাঁরা জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
তবে উদ্যোক্তা হওয়ার এই পথে পদে পদে অপেক্ষা করে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা আর ঝুঁকি। প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব, বাজারের পরিবর্তনশীলতা ও অনিশ্চয়তা, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন সরকারি নীতিমালার পদ্ধতিগত জটিলতা এবং কখনও কখনও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা উদ্যোক্তাদের অগ্রযাত্রাকে কঠিন করে তুলতে পারে। এর পাশাপাশি ব্যবসায়িক ব্যর্থতার আশঙ্কা তো থাকেই। কিন্তু একজন সত্যিকারের উদ্যোক্তা এসকল বাধা-বিপত্তিকে দৃঢ়তার সাথে অতিক্রম করেই নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান।
আশার কথা হলো, বর্তমানে বাংলাদেশেও উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। সরকার তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সাথে সঙ্গতি রেখে ই-কমার্স, তথ্যপ্রযুক্তি এবং বিভিন্ন সেবা খাতে涌现 হচ্ছে অসংখ্য নতুন উদ্যোক্তা। এই নবীন উদ্যোক্তারাই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান স্থপতি হিসেবে আবির্ভূত হবেন।
পরিশেষে, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রয়োজন স্বপ্ন দেখার অদম্য স্পৃহা, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য নিরলস পরিশ্রম করার মানসিক প্রস্তুতি এবং যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও হাল না ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ইস্পাত কঠিন মনোবল। সঠিক ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তির প্রয়োগ এবং অটুট আত্মবিশ্বাস থাকলে যেকোনো উদ্যোক্তাই সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারেন এবং দেশ ও দশের সার্বিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হন। উদ্যোক্তারাই হলেন আধুনিক অর্থনীতির প্রাণস্পন্দন এবং ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা।