ব্যাংক হলো এমন একটি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান যা প্রধানত জনসাধারণের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকার হিসাবের মাধ্যমে অর্থ আমানত হিসেবে সংগ্রহ করে এবং সেই সংগৃহীত অর্থ ব্যক্তি বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট শর্তে ঋণ হিসেবে প্রদান করে থাকে। আধুনিক অর্থনীতির শিরা-উপশিরায় রক্ত সঞ্চালনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ব্যাংক আঞ্জাম দেয়, তাই একে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবেও অভিহিত করা হয়। ব্যাংকের কার্যক্রম কেবল অর্থ জমা রাখা বা ঋণ বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং একটি দেশের সামগ্রিক আর্থিক কাঠামো পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে।
ব্যাংকের মৌলিক কার্যাবলী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি বিভিন্ন আঙ্গিকে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে। প্রথমত, ব্যাংক চলতি, সঞ্চয়ী ও স্থায়ী বিভিন্ন ধরনের হিসাব খুলে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অলস অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়া গ্রাহকদের জন্য একটি নিরাপদ সঞ্চয়ের সুযোগ তৈরি করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির জন্য পুঁজি গঠনে সহায়তা করে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক তার সংগৃহীত আমানতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন উৎপাদনশীল খাতে ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন, গৃহ নির্মাণ প্রকল্প, শিক্ষাখাতে অর্থায়ন, কৃষি উন্নয়নসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এই ঋণ সহায়তা প্রদান করা হয়, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করে। তৃতীয়ত, ব্যাংক চেক, ব্যাংক ড্রাফট, অনলাইন ফান্ড ট্রান্সফার, এটিএম কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং প্রভৃতি আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে অত্যন্ত দ্রুততা ও নিরাপত্তার সাথে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বা এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে অর্থ স্থানান্তরের নির্ভরযোগ্য সেবা প্রদান করে।
এছাড়াও, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমদানি ও রপ্তানি সংক্রান্ত কার্যক্রমে লেটার অফ ক্রেডিট (এলসি) খোলা, বৈদেশিক মুদ্রার কেনাবেচা ও বিনিময় হার নির্ধারণের মতো জটিল সেবা প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে সহজতর করে তোলে। এর পাশাপাশি গ্রাহকদের মূল্যবান জিনিসপত্র নিরাপদে সংরক্ষণের জন্য লকার সুবিধা, দৈনন্দিন লেনদেনের জন্য ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করা, বিনিয়োগ সংক্রান্ত পরামর্শ প্রদান এবং সরকারের পক্ষে বিভিন্ন কোষাগারীয় কার্যক্রম পরিচালনা সহ আরও অনেক আর্থিক পরিষেবা ব্যাংক দক্ষতার সাথে প্রদান করে থাকে।
একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, দেশের সামগ্রিক মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লাইসেন্স প্রদান করে, তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে, মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
ব্যাংক ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি অলস সঞ্চয়কে উৎপাদনশীল বিনিয়োগে রূপান্তরিত করে দেশের অভ্যন্তরে মূলধন গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ঋণের সহজলভ্যতা নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে। আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ আর্থিক সেবার আওতায় আসে, যা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পরিধি বাড়ায় এবং দারিদ্র্য বিমোচনে পরোক্ষভাবে অবদান রাখে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতা বিতরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজেও ব্যাংক নির্ভরযোগ্য সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
তবে, ব্যাংক ব্যবস্থার পরিচালনায় কিছু ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হয়। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া, সাইবার নিরাপত্তার হুমকি, আর্থিক জালিয়াতি এবং অবৈধ অর্থপাচার প্রতিরোধ করাও বর্তমান সময়ের ব্যাংকগুলোর জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়নের সাথে সাথে ব্যাংকিং সেবার ধরনেও আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং এর মতো উদ্ভাবনী সেবাগুলো এখন গ্রাহকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে, যা ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি দক্ষ, স্বচ্ছ ও গ্রাহকবান্ধব করে তুলছে। পরিশেষে বলা যায়, একটি শক্তিশালী, সুসংগঠিত এবং সুশাসিত ব্যাংক ব্যবস্থা যেকোনো দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত। এটি জনগণের আস্থা অর্জন করে আর্থিক লেনদেনকে নিরাপদ ও গতিশীল করে এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে নিরন্তর সহায়তা করে যায়।