বিশ্ব রাজনীতি মানেই বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক ও ক্ষমতার সমীকরণ

LinkedIn
Twitter
Facebook
Telegram
WhatsApp
Email
Global Politics: Our Shrinking World, Our Closing Minds

বিশ্ব রাজনীতি হলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং অন্যান্য অ-রাষ্ট্রীয় কুশীলবদের (যেমন বহুজাতিক কর্পোরেশন, এনজিও) মধ্যেকার জটিল সম্পর্ক, মিথস্ক্রিয়া এবং ক্ষমতার গতিশীলতাকে নির্দেশ করে। এটি মূলত সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের বৈদেশিক নীতি, তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সংঘাত এবং বিশ্বজনীন সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির এই যুগে কোনো দেশই বিচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকতে পারে না, ফলে বিশ্ব রাজনীতির গতিপ্রকৃতি প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে।

ঐতিহাসিকভাবে, বিশ্ব রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা, সাম্রাজ্য বিস্তার, ঔপনিবেশিকতা এবং পরবর্তীকালে ঠান্ডা যুদ্ধের মতো ঘটনাপ্রবাহ পরিলক্ষিত হয়েছে। বর্তমানে, বিশ্ব রাজনীতিতে অর্থনৈতিক শক্তি, প্রযুক্তিগত আধিপত্য, সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং সামরিক সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক কূটনীতির আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিশ্ব রাজনীতিতে সমন্বয় সাধন, নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা এবং সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের চেষ্টা করে।

বিশ্ব রাজনীতির আলোচনায় প্রায়শই বিভিন্ন তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির অবতারণা হয়, যেমন বাস্তববাদ, উদারতাবাদ, নির্মাণবাদ ইত্যাদি। বাস্তববাদীরা মনে করেন, রাষ্ট্রগুলো মূলত আত্মস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয় এবং ক্ষমতার লড়াই বিশ্ব রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। অন্যদিকে, উদারতাবাদীরা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বিশ্ব রাজনীতিতে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা একটি প্রধান লক্ষ্য। পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ, সন্ত্রাসবাদ দমন, আঞ্চলিক সংঘাত নিরসন এবং সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব রাজনীতির বড় চ্যালেঞ্জ।

অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন বিশ্ব রাজনীতিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বাণিজ্য উদারীকরণ, পুঁজির অবাধ প্রবাহ এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর একদিকে যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তেমনি অন্যদিকে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্যও বাড়িয়েছে। বাণিজ্য যুদ্ধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা অনেক সময় আন্তর্জাতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারী, শরণার্থী সংকট এবং আন্তঃসীমান্ত অপরাধের মতো সমস্যাগুলো কোনো একক দেশের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়, তাই এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।

বিশ্ব রাজনীতিতে উদীয়মান শক্তিগুলোর উত্থান, যেমন চীন, ভারত, ব্রাজিল, ক্ষমতার প্রচলিত মেরুকরণে পরিবর্তন আনছে। এর ফলে নতুন জোট এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং পরিবেশ সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো বিশ্ব রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব পাচ্ছে এবং অনেক দেশের বৈদেশিক নীতিকে প্রভাবিত করছে। গণমাধ্যমের বিস্তার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে জনমত বিশ্ব রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

পরিশেষে, বিশ্ব রাজনীতি একটি অত্যন্ত গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল ক্ষেত্র। রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সহযোগিতা ও সংঘাতের মধ্য দিয়েই এর পথচলা। পারস্পরিক বোঝাপড়া, কূটনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কেবল একটি অধিকতর শান্তিপূর্ণ, ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ আবাসভূমি নিশ্চিত করবে।

আরও পড়ুন